
নিজস্ব প্রতিনিধি
গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম: বহুমুখী চরম সংকটে। আওরঙ্গজেব কামাল : বর্তমানে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র যেন চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গণতন্ত্র তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না। অপরদিকে পেশী শক্তির চাপ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মত সৃষ্টির মাধ্যমে গণমাধ্যম কর্মী হামলা মামলার শিকার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের জীবনও দিতে হচ্ছে। তার দৃষ্টান্তও উদাহরণ গাজীপুরের তুহিন। বাংলাদেশে ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে অন্তবর্তীকালীন দেশ পরিচালনায় অধিষ্ঠিত হয়। সে সময় সকল দল-মত নির্বিশেষে রাষ্ট্রের যে চিত্র ছিল সেটা দেখে মনে হয়েছিল বাংলাদেশে ভালো কিছু হবে। দেশের জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন হবে। যেহেতু বিগত পনের বছর যাবত স্বৈরাশাসকের পতন হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সে আশায় গুড়েবালি বলে ধারণা করছেন বিশিষ্টজনেরা। দেশে যেভাবে মারামারি, হানাহানি, চাঁদাবাজি ,দখল বাজি রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে তা দেখে যে কোন লোক আতঙ্কে রয়েছে। বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন অস্থিতিশীলতার মুখে পড়েছে, তেমনি গভীর সংকটে পড়েছে গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। রাষ্ট্রশক্তি, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর টানাপোড়েনে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ ও সাংবাদিকতার নিরপেক্ষতা এখন বড় প্রশ্নের মুখে।গণঅভ্যুত্থানের পর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করার দাবি তুললেও এখনও কার্যকর কোনো নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি হয়নি। নির্বাচনী কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে, পাশাপাশি বিগত তিন টি নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে জনগণকে। এছাড়া ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে অনেক প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার বদলে সংকটই বেড়েছে। ইতিমধ্যে জামাত ইসলামী বাংলাদেশ পেয়ার পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করার হুমকি দিয়েছে। একইসাথে, গণমাধ্যম এখন বহুমুখী চাপের মধ্যে রয়েছে। সাংবাদিকরা মাঠপর্যায়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে হামলা, মব এর শিকার, মামলার ভয় এবং সেন্সরশিপের শিকার হচ্ছেন। গণঅভ্যুত্থানের পরও বহু সাংবাদিককে হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনসহ নানা আইন সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে। ফলে সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ও অনুসন্ধানী রিপোর্টিং কার্যত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যে কারণে জনগণের আস্থা ও অনিশ্চয়তা ক্রমেই বাড়ছে। হয়রানি বা নিপীড়ন বাংলাদেশে ৪৯৬ জন সাংবাদিক হেনস্তার শিকার হয়েছেন আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫-এর মধ্যে। বর্তমানে সেটা কত সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ঐ সময় সাংবাদিক কাজের সময় খুন হয়েছেন। সংক্রমণিক মামলায় নাম থাকা সাংবাদিক ৫ আগস্টের পরের আন্দোলন-সংক্রান্ত ঘটনাসমূহে ২৬৬ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড-সংক্রান্ত মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, আগস্ট ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫-এর মধ্যে সাংবাদিকদের ওপর ৩৯৮টি হামলা বা হয়রানির ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বর্তমানে তা প্রায় ৫ শতাধিক দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন মামলায় অনেক কে গ্রেফতার হয়েছে। আগস্ট-জুলাই-পর্বে সাংবাদিকদের অপরাধবাদী মামলা (যেমন ‘উচ্চমাত্রার হত্যাকাণ্ড’ সংক্রান্ত) অভিযুক্ত হিসেবে নাম থাকা: ২৬৬ জন। আমি অবশ্যই এ বিষয়ে কিছু বলছি না। আমার জানা মতে ঢাকা মহানগরসহ সাভার ও আশুলিয়ায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে। এছাড়া দেশের অনেকে থানায় মামলা না করতে পেরে, আদালতে গিয়েছে। কিন্ত বিজ্ঞ আদালত এসব মামলা আমলে না নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য পাঠিয়েছেন। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে অনেকে বানিজ্য করছে এমন অভিযোগ উঠেছে। মজ্ঞুরুল নামের এক মামলার বাদী জানাই সাংবাদিকদের নামে মামলা হয়েছে তা আমি নিজেই জানিনা। তিনি বলেন, পরে আমি বিষয়টি সত্যতা যাচাই করে তারা নির্দোষ হওয়ায় তাদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য এফিডেভিট করে দিয়েছি। এবং তদন্ত কর্মকর্তাকে তাদের এ মামলা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য বলেছি। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে সাংবাদিক বা অনেক ব্যাক্তিকে হয়রানী করা হয়েছে। এ থেকে এখনো পর্যন্ত অনেক নির্দোষ ব্যাক্তি বা সাংবাদিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি ভূক্তভোগী সাংবাদিদের সাথে কথা বলেছি। তারা এই সব হয়রানী মামলার হাত থেকে পরিত্রাণ চায়। বর্তমান সরকারের কাছে তাদের দাবী সঠিক প্রমান ছাড়া আমাদের উপর অনেক অবিচার করা হচ্ছে। বর্তমান সরকার এ বিষয় অবশ্যই দয়া করে নজর দিবেন। এছাড়া সম্পতি সময়ের ঘটে যাওয়া ঘটনার মধ্যে গাজীপুরের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন কে হত্যার ঘটনা নেট দুনিয়ায় সাড়া ফেলেছে। এছাড়া বিভু রঞ্জন সরকার নামের সিনিয়র সাংবাদিকের মরদেহ মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার। শুধু আগস্ট ২০২৫-এ HRSS রির্পোট বলছে, “একটি সাংবাদিক খুন হয়েছে, ৩৩ জন আহত হয়েছে, ৫ জন হামলার শিকার, ১১ জন হুমকি পেয়েছে, ও একজন আটক হয়েছেন। আমি এ আলোচনা এই কারনে গণমাধ্যম বা সাংবাদিক নিরাপদ না থাকলে কখনো কোন দেশে গণতন্ত্র নিরাপদ থাকে না। আনারা অবশ্যই জানেন গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম— উভয়ই একটি রাষ্ট্রের ভিত্তি। বাংলাদেশে বর্তমানে গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম দু’টিই দুর্বল হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ঘিরে অনিয়ম, রাজনৈতিক দমননীতি ও সহিংসতার কারণে গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ভিন্নমত দমনে মামলা, গ্রেপ্তার ও রাজনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গণতন্ত্রের স্বাভাবিক চর্চাকে ব্যাহত করছে। অন্যদিকে, গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। সাংবাদিকরা হয়রানি, হামলা ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। ফলে জনগণের তথ্য জানার অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে, আর রাষ্ট্রের দুটি মৌলিক ভিত্তি – গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম – আজ নাজুক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ তাদের ভোটাধিকার ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। জাতিসংঘের মতে, গণতন্ত্র এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে নীতি নির্ধারণ বা প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার থাকে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাব, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সব নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ থাকে, যা প্রয়োগ হয় সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে। এককথায় বলতে গেলে, গণতন্ত্রের অর্থ জনগণের শাসন।পৃথিবীতে স্বাধীন দেশগুলোর শাসনব্যবস্থাকে চারটি ভাগে মূল্যায়ন করা হয়। পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা। কিন্ত আমরা একটি ক্রান্তিকাল পার করছি। এখন গণতন্ত্রে উত্তরণের একটিই পথ—নির্বাচন। বর্তমানে সেই নির্বাচন হথে এখন মনে হচ্ছে বড় বাঁধা । জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বাহাত্তুরের সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি করে আসছে। নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও কাঙিক্ষত সংস্কার না হলে এনসিপি ভোটে অংশ নেবে কিনা সেটি নিয়েও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে চব্বিশের অভ্যুত্থানকে অস্বীকার করা হচ্ছে। এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘গত বছরের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার এক নজিরবিহীন অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ইতিহাসের এক ভয়ংকর স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। এখন তাই ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে আমাদের একযোগে কাজ করে যেতে হবে। আমাদের রাষ্ট্র মেরামতের ভিত্তি হবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের সব মূলনীতির প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োগ। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশবাসী ১৬ বছর এক ভয়াবহ দুর্দিন অতিক্রম করে গত বছর জুলাই-আগস্টে ঐতিহাসিক রক্তস্নাত আন্দোলনের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করলেও এখনও পূর্ণ গণতন্ত্র আসেনি। অবাধ, মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দিতে হলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে।রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সর্বজনীন শিক্ষা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ছাড়া প্রকৃত গণতন্ত্র সম্ভব নয়। জামাতের আমির ডা শফিকুল ইসলাম বলেন পিআর পদ্ধতিতে ভোট হলে ভোট আর পঁচবে না, প্রতিটি ভোট মূল্যায়িত হবে।বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান ও বিচার শেষে করে দ্রুত সময়ের মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। আগে যারা নির্বাচন নির্বাচন করে মুখে ফেনা তুলেছে, তারাই এখন বয়কট বয়কট করছে। মূলত তারা শিক্ষার্থীদের রায়ের প্রতি অসম্মান দেখাচ্ছে। এদিকে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ ৫ দফা দাবিতে ৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। কর্মসূচির আওতায় আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল ছাড়াও ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহরে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। জামাতের ৫ দফা দাবিতে রয়েছে (১) জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।(২) আগামী জাতীয় নির্বাচনে সংসদের উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করতে হবে।(৩) অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।(৪) ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম ও গণহত্যা এবং দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করতে হবে।(৫) স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। এখন প্রশ্ন এগুলি কি বর্তমান সরকার পুরন করতে পারবে? না নির্বাচন নিয়ে কোন সমস্যা হবে। গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন নেতৃত্ব বা নতুন ধারার গণতন্ত্রের আশা জেগেছিল, কিন্তু বাস্তবতায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সংবাদপত্রের সংকোচ জনগণের আস্থাকে দুর্বল করেছে। এখন তাদের মনে একটি প্রশ্ন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না অন্য কোন অশুভ সংকেত দেখা দিবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়া নয়—স্বাধীন সাংবাদিকতাকেও রক্ষা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা অতি জরুরি। অন্যথায় বহুমুখী এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ তৈরি হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই হতে পারে স্থিতিশীল গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত।
লেখক ও গবেষক:
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি, ঢাকা প্রেসক্লাব